অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ এনে যশোরের মণিরামপুরে এক কলেজছাত্রীকে (১৮) বিবস্ত্র করে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে তার ভিডিও ধারণের অভিযোগ উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ধরে উপজেলার মনোহরপুরে ওই তরুণীর বাড়িতে চলে এই নির্যাতন। স্থানীয় ১০-১২ যুবক তরুণীর পা বেঁধে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্যাতন করে। একই সঙ্গে তারা ওই তরুণী ও তার বৃদ্ধা মাকে মারপিট করে। যার ভিডিওচিত্র এখন এলাকার অনেকের হাতে হাতে।
মেয়েটি স্থানীয় একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে চারজনকে আটক করে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে পুলিশ। তবে, অন্যরা এখনো অধরা থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে পরিবারটি। এদিকে ঘটনাটি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে এলাকায় তোলপাড় চলছে। এলাকার মানুষ জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করছেন। বৃহস্পতিবার কথা হয় নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী ও তার মায়ের সঙ্গে। সেই রাতের ভয়াল ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার তারা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। চাইছেন, নরপশুদের সঠিক বিচার।
ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবার রাতের। রাত সাতটার দিকে ওই তরুণীর সঙ্গে দেখা করতে যায় উপজেলার সাতনল বাজার এলাকার আব্দুল মালেকের ছেলে দীন মোহাম্মদ। ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকা যখন ঘরে, সেই সময় বাইরে থেকে ১০-১২ যুবক এসে দরজা খুলতে বলে। পাশের ঘরে ছিলেন মেয়েটির মা। লোকজনের শব্দ শুনে তিনি বেরিয়ে আসেন। মেয়েটি ভেতর থেকে দরজা খুলতেই সবাই ঢুকে পড়ে। সঙ্গে ঢোকেন মেয়েটির মাও। ভেতরে ঢুকেই ওই যুবকদের মধ্যে কয়েকজন দীন মোহাম্মদকে মারধর শুরু করে।
এসময় তারা মেয়েটিকে খাটের ওপরে শুইয়ে দিয়ে টানাহেঁচড়া করে তাকে বিবস্ত্র করে ফেলে। তারপর মেয়েটির শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে তাকে যৌন নিপীড়ন করে। হায়নার দল মেয়েটির দেহের বিভিন্ন স্থানে কামড়ে ছিড়ে নেয়। যার ভিডিও ধারণ করে তারা। মেয়েকে রক্ষায় তার বৃদ্ধা মা এগিয়ে গেলে তাকেও মারধর করা হয়। বারবার বৃদ্ধাকে ফেলে দিয়ে মেয়ের ওপর নির্যাতন চালায়। এভাবে চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। পরে মা-মেয়ের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করেন। রাত ১২ টার দিকে খবর পেয়ে পুলিশ যায় ঘটনাস্থলে।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই কলেজছাত্রী বলেন, 'আমি ও দীন মোহম্মদ ঘরে বসে কথা বলছিলাম। তখন এলাকার হেলাল বিশ্বাস, নূর ইসলাম মোল্যা, তার ছোটভাই হেলাল মোল্যা, বাবুল, বাচ্চু, মামুন, আজহারুল ও রাজ্জাকসহ ১০-১২ জন দরজা খুলে আমার ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই ওরা আমাকে খাটের ওপর ফেলে দেয়। ২-৩ জন আমার দেহের ওপর উঠে টান দিয়ে আমার জামা-কাপড় ছিড়ে বিবস্ত্র করে আমাকে কামড়াতে থাকে। ওই সময় ওরা গালিগালাজ ও মারপিটও করে। মা এগিয়ে এলে ওরা মায়ের মাথা দেয়ালের সাথে ধাক্কা দিতে থাকে। পুরো ঘটনাটা ভিডিও করে ওরা।'
তিনি বলেন, 'ওরা আমাকে ছিড়ে খেয়েছে; আমি এর বিচার চাই।'
তরুণীর দাবি, প্রায়ই কলেজ থেকে ফেরার পথে নূর ইসলাম তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিত। রাজি না হওয়ায় সে হুমকি দিত। নির্যাতনের সময় নূর ইসলাম বলেছিল- সহযোগীদের না কি এক লাখ টাকা দিয়ে ভাড়া করে এনেছে।
মেয়েটির মা জানান, ওরা মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেখে তিনি ভেতরে ঢুকতে যান। তিনি মেয়েকে বুকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে ওরা মেয়ের ওপর অত্যাচার করে। মেয়েকে দীন মোহম্মদের কোলে বসিয়ে জোর করে ভিডিও করে। মেয়ে রাজি না হওয়ায় ওকে মারধর করে। এভাবে চলে রাত ১২টা পর্যন্ত।
তরুণীর মা আরো বলেন, 'আমাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে ওদের থামতে বললে তাদের একজনকে মেরে রাস্তায় উঠিয়ে দেয় হামলাকারীরা। পরে পুলিশ এলে ওরা চলে যায়।'
পুলিশ এসে রাতে দীন মোহম্মদ ও ওই তরুণীকে নেহালপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পুলিশ যাওয়ার পর আজহারুল, রাজ্জাক, নাসির ও হেলাল জোর করে স্টাম্পে সই নিয়ে বাড়ি থেকে নেমে যেতে হুমকি দেয় বলে জানান ওই তরুণীর মা।
তিনি জানান, পরদিন সকালে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। ঘটনা শুনে চারজনকে আটক করে। পরে ওদের মোবাইলে ভিডিও দেখে পুলিশ মামলা নিয়ে চারজনকে কোর্টে চালান দেয়।
নির্যাতনকারীদের মধ্যে পুলিশ চারজনকে ধরলেও বাকিরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের আটকের দাবি জানিয়েছে পরিবারটি। তাছাড়া,ওই চারজন ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসে 'দেখে নেবে' বলে হুমকি দিচ্ছে অভিযোগ করে পরিবারটি নিরাপত্তাহীনতার দাবি করেছে।
এদিকে তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে ন্যায়বিচারের দাবি করছেন এলাকাবাসী।
মনোহরপুর কারিগরি ও বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, 'এই নির্মম ঘটনার অবশ্যই বিচার হওয়া দরকার।' নেহালপুর পুলিশ ক্যাম্পের আইসি ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই খাইরুল বাসার বলেন, 'ঘটনার বর্ণনা শুনে চারজনকে আটক করা হয়েছে। পরে তাদের কাছ থেকে ভিডিও উদ্ধার হওয়ার পর পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা নিয়ে তাদের চালান দেওয়া হয়েছে। মামলায় চারজন এজাহারনামীয়সহ ২-৩ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।' ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের আটকের চেষ্টা চলছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।